Friday 6 April 2012

আল্লাহ আমাদের তওফিক দেও

গ্যাস নাই। পানি নাই। বিদ্যুৎ নাই। শেয়ারবাজারে পুঁজি নাই। স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি নাই। যানজটে অচল নগরীতে চলাফেরার সুযোগ নাই। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের কূলকিনারা নাই। ব্যবসা নাই। বাণিজ্য নাই। বিনিয়োগ নাই। শ্রমবাজার নাই। দ্রব্যমূল্য নাগালে নাই। চাকরি নাই। বাকরি নাই। কর্মসংস্থানের সুযোগ নাই। রাজনীতিতে ঐক্য নাই। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নাই। রাজনীতিতে পরস্পরের আস্থা নাই। বিশ্বাস নাই। সংসদ কার্যকর নাই। রাজপথে গণতন্ত্র নাই। সংসদে গালি আছে তালি নাই। শিক্ষাঙ্গনে পরিবেশ নাই। ঘুষ ছাড়া কাজ নাই। তদবির ছাড়া প্রাপ্তি নাই। দলীয়করণ-তোষামোদির সীমা নাই। না থাকা, না পাওয়ার বেদনায় দগ্ধ জনজীবনের কোথাও কোনো শান্তি নাই। স্বস্তি নাই। অন্তহীন নাই-এর মধ্যে অসীম ধৈর্য নিয়ে তবুও মানুষ আশায় বুক বাঁধে। তবুও মানুষের স্বপ্ন ফুরিয়ে যায় না। সরকার, বিরোধী দল সবার কাছেই সুশাসন চায়। গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকতা চায়। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা চায়। দলীয়করণের ইতি চায়। মেধা ও যোগ্যতার মূল্যায়ন চায়। গত কুড়ি বছরের গণতান্ত্রিক শাসনামলে পর্যায়ক্রমে দুর্নীতি, দলীয়করণ, প্রতিহিংসার রাজনীতি তীব্র হলেও মানুষের স্বপ্ন ফুরিয়ে যায়নি। দেশপ্রেমিক সাত কোটি মানুষের এই দেশ জাতির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে একসুতোয় বাঁধা পড়ে '৭১ সালে সুমহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন করেছিল। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার স্বপ্নে বিভোর বাংলাদেশের জনগণের সামনে রাজনীতির নিয়ন্ত্রক প্রধান দুই দলের দুই নেত্রী গণতন্ত্রের সংগ্রামের ডাক দিলে সেখানেও জীবন-যৌবন বিসর্জন দিয়ে মানুষ গণতন্ত্র মুক্ত করেছে কিন্তু তাদের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির যোগফল মেলেনি। দিনে দিনে বেড়েছে প্রত্যাশা ও অঙ্গীকারের সঙ্গে জনগণের পাওনার হিসাব। দলে দলে গণতন্ত্র নাই, মাঠে নাই, ঘরে নাই। তবুও মানুষ বিভক্ত রাজনীতির ত্যক্ত-বিরক্ত অভিজ্ঞতায় দুই সে াতধারায় অবস্থান নিলেও এশিয়া কাপ ক্রিকেট ফাইনালে 'বাংলাদেশ বাংলাদেশ' ধ্বনিতে সজলনয়নে ১৬ কোটি মানুষ একসুতোয় বাঁধা পড়েছিল। গভীর দেশপ্রেমে মগ্ন জনগণ এখনো দেশকে মালয়েশিয়া-সিঙ্গাপুরের মতো উন্নত দেশ হিসেবে দেখতে চায়। ৪১ বছরে যদি জাতির নেতৃত্বকে হত্যা না করা হতো, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে দুর্নীতি, অপশাসন আর দলবাজি রোধ করা যেত, হয়তো দেশ সেখানেই যেত। অনেকে হয়তো বলবেন, মওলানা ভাসানীর মোটা ভাত, মোটা কাপড়ই নয়, বেগম খালেদা জিয়ার ডাল-ভাতই নয়, শেখ হাসিনার মাছ-ভাতেও এগিয়েছে দেশ। শাসকদের ভেতরে ও আশপাশে থাকা বিশেষজ্ঞরা প্রবৃদ্ধি অর্জনের হিসাব দিয়ে দেশ এগিয়ে যাওয়ার প্রশংসায় আত্দসুখ খুঁজবেন। কিন্তু কেউ আত্দজিজ্ঞাসা করে খুঁজবেন না হানাহানির রাজনীতি, দুর্নীতি, দলীয়করণ নির্বাসনে দিয়ে জাতীয় ঐক্যের রাজনীতি ও সুশাসন অব্যাহত রাখলে দেশ আজ কোথায় থাকত? দিনে দিনে সর্বত্র ঘটেছে অবক্ষয়। বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির জন্য জনজীবনে এখন তীব্র হাহাকার। শিল্প-কলকারখানা বিদ্যুৎ, গ্যাস সংকটের কারণে বিপর্যয়ের মুখে। ব্যাংকের তারল্য সংকট, চড়া সুদ বিনিয়োগকারীদের পথে বসিয়ে দিচ্ছে। কেউ কেউ ঘরে উঠে যাচ্ছেন। দলীয়করণের ছোঁয়া লেগেছে সর্বত্র। তৃণমূল বিস্তৃত হয়েছে দুর্নীতি। শুধু রাজধানীতেই নয়, প্রত্যন্ত অঞ্চলেও শাসক দলের নেতা-প্রতিনিধি আর প্রশাসনের কর্তারা মিলে ফুলে-ফেঁপে উঠছেন। নাভিশ্বাস উঠছে সাধারণ মানুষের। পেশাদারদের। কি সরকারি কর্মকর্তা, কি ব্যবসায়ী, কি বা নানা পেশার লোকজন। ব্যাংক, বীমা যেখানেই সরকারি অনুমোদন সেখানেই দলীয় লোকদের প্রাধান্য। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার অনুমতি দলবাজ, তদবিরবাজ ছাড়া কেউ পাননি। মন্ত্রী-এমপিরা দলীয় ক্ষমতার সুবাদে রাতারাতি ব্যাংকমালিক হয়ে ধনাঢ্য ব্যক্তি হয়ে যাচ্ছেন। অসুস্থ রাজনীতির প্রতিযোগিতা চলছে। আগেও চলেছে, এখনো চলছে। যেন এক হারজিতের লড়াই। পেশাদার ব্যবসায়ীরা ফাইলের পেছনে ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা সব খবর রেখে ত্রিসীমানায় আসতে নারাজ। রাজনীতি থেকে ধীরে ধীরে রাজনীতিবিদদের নির্বাসনকরণ প্রক্রিয়া মেধাবী প্রজন্মকে আগ্রহী করছে না। সংসদে যাদের মনোনয়নভাগ্য ঘটছে বা যারা সংরক্ষিত আসনে আসছেন, তাদের অনেকের কাছে গণতন্ত্র ও মূল্যবোধ আমলই পাচ্ছে না। রাজনৈতিক শিষ্টাচার, সংসদীয় রীতিনীতি ক্রমে ক্রমে নির্বাসিত হচ্ছে। গণতন্ত্রের জন্য যুগে যুগে যারা জীবন দিয়েছেন তাদের আত্দা ক্রন্দন করছে। শেয়ারবাজারে রিক্ত-নিঃস্ব মানুষ পুঁজি হারানোর বেদনার চেয়েও লুটেরাদের আস্ফালন দেখে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ অনুভব করছে। লুটেরাদের ধরার উদ্যোগ পর্যন্ত নেওয়া হয়নি। সেনা শাসনামল দূরে থাক, অতি কাছের ওয়ান-ইলেভেন থেকেও শাসক ও বিরোধী দল কেউ শিক্ষা নেয়নি। রাজনীতির গতিপ্রকৃতি নির্ণয়, গণতান্ত্রিক রীতিনীতি, জাতীয় ইস্যু, সংসদসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা বৃদ্ধিতে অভিন্ন অবস্থানে আসতে পারেনি। শাসকরা ফের ক্ষমতায় আসার জন্য মরিয়া। জনমত পক্ষে টানতে সমুদ্র জয়, সমুদ্র জয় বলে সারা দেশ কাঁপিয়ে দিচ্ছেন। আওয়ামী লীগের মতো জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দলে এতিম বামদের প্রভাববলয় অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে। বিরোধী দল যাকে পাচ্ছে তাকেই সঙ্গে নিয়ে মধ্যপন্থি আধুনিক দলের ধ্যানধারণা বাদ দিয়ে গণতন্ত্র, গণতন্ত্র আর তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের দাবিতে আলটিমেটাম দিয়ে রাজপথে হাঁটছে। সামনের রাজনীতি অশান্ত, অগি্নগর্ভ ও সংঘাতময় হওয়ার আশঙ্কা সবার। অসংখ্য হত্যাকাণ্ডের কূলকিনারা নাই। গুম খুনের হদিস নাই। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের আসামি গ্রেফতারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটামের প্রায় দুই মাস পার হলেও সত্য উদ্ঘাটিত হয়নি। অবুঝ 'মেঘ' রাস্তায় নেমে ফ্যালফ্যাল করে তাকায়। সাংবাদিক সমাজ এককাতারে দাঁড়িয়ে আন্দোলনে নামে। শাসক ও তাদের মোসাহেবদের বিবেক স্পর্শ করে না। শাসক মহলের অন্দরে ঠাঁই পাওয়া অতি উৎসাহী দালালরা এর নেপথ্যে বিদেশি অর্থের গন্ধ খুঁজে বেড়ান। আন্দোলনরত সাংবাদিক সমাজের নেতাদের নিয়ে উন্মাদের অপপ্রচার চালান। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কেন ভালো নাই, গ্যাস-পানি-বিদ্যুৎ ও যানজটের জন্য জনজীবনে কেন সুখ নাই তার উত্তর খোঁজেন না। বিদ্যুতের জন্য জনতার গাল খায় সরকার। টাকা কামায় সুবিধাবাদীরা। সাধারণ মানুষের কথা কেউ ভাবেন না। সরকারের অন্দরে-বাইরে শাসকের কপালে ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাণের 'তওফিক' লাভের চুটকি চানাচুরের মতো বাজে। মানুষের অন্তহীন বেদনা ও দুর্ভোগের কথা ঠাঁই পায় না। যে জাতি যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে, যে জনগণ সংগ্রাম করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে, যে মানুষ ব্যালটবিপ্লবে সরকার নির্বাচিত করে অসীম ধৈর্য নিয়ে প্রতিটি আমলের চিত্রনাট্য দেখে সয়ে যায় তবু বেদনায় দগ্ধ হয়ে বিক্ষোভ করে না। শান্তিপ্রিয় মানুষ অসীম ধৈর্য ধরে সরকারের কাছেই প্রত্যাশা করে। মাঝেমধ্যে পানি-বিদ্যুতের জন্য বউ-ঝিরা রাস্তায় নেমে এলেও ফের শান্ত হয়ে যান। তবুও এক সরকার পাঁচ বছরে বিদ্যুৎ সমস্যা বা যানজট থেকে মানুষকে মুক্ত করে যেতে পারেনি। কলঙ্কের দায় নিয়ে বিদায় নিয়েছে। আরেক সরকার দুই বছর ক্ষমতায় থেকে ব্যর্থতার দায় নিয়ে নিন্দিত হয়েছে। তিন বছরে একটি ফ্লাইওভার নির্মিত হয় না অথচ শাসকদের হেরেমে আশ্রিত বা নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা নামে-বেনামে শিল্পকারখানা, টিভির মালিক হয়ে যান। বারে বারে হন। চলমান সরকার তিন বছরেও মানুষের দুঃখ ঘোচাতে পারেনি। দিতে পারেনি জনজীবনের স্বস্তি। তবুও এ দেশের মানুষ, এই নগরবাসী নীরবেই সয়ে যায়। প্রতিবাদমুখর হয় না জনজীবনের দুর্ভোগের বিরুদ্ধে। আল্লাহর কাছে মানুষ মুনাজাত করে ধৈর্য ধারণের, বেদনা সইবার তওফিক দিতে। আল্লাহ আমাদের তওফিক দাও।

No comments:

Post a Comment

 
Design by BPL News | BPL News by Recreation - International News | Press Release Distribution